আমরা দেখেছি যে কুর’আনে বলা হয়েছে, বাইবেলের তাওরাত, যাবুর এবং ইনজীল (আল কিতাব) বিকৃত হয়নি। কুর’আনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে ইনজিলের অনুসারীরা নবী মুহাম্মদ(সাঃ) এর সময়ে, প্রায় ৬০০ খ্রীষ্টাব্দ অব্দি আল্লাহর বার্তা প্রচার করেছিলেন – সুতরাং এ সময়ের পূর্বে এটি বিকৃত হয়নি। কুরআন ঘোষণা করে যে ইঞ্জিলের মূল বার্তাটি ছিল আল্লাহর বাণী, এবং . তাঁর কালাম কখনও পরিবর্তন করা যায় না। যেহেতু এই উভয় বিবৃতিই সত্য, এর অর্থ হলো আল কিতাবের কালামগুলো মানুষের পক্ষে বিকৃত করা অসম্ভব (তাওরাত, যাবুর এবং ইনজীল =বাইবেল)।
হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) এবং বাইবেল
এই প্রসঙ্গে হাদীস ও সুন্নাহ কী বলে তা আমরা এখানে অধ্যয়ন করব। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) সময়ে নীচের হাদীসগুলি কিভাবে তওরাতের ও ইঞ্জিলের অস্তিত্ব এবং এর ব্যবহারকে নিশ্চিত করে তা লক্ষ্য করুন।
অতঃপর তাঁকে নিয়ে খাদীজাহ (রাঃ) তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকাহ ইবনু নাওফাল ইবনু ‘আবদুল আসাদ ইবনু ‘আবদুল ‘উযযাহ’র নিকট গেলেন, যিনি অন্ধকার যুগে ‘ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইবরানী ভাষায় লিখতে পারতেন এবং আল্লাহর তাওফীক অনুযায়ী ইবরানী ভাষায় ইনজীল হতে ভাষান্তর করতেন। “আল-বুখারী খন্ড ১, গ্রন্থ ১, নং ৩
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আহলে কিতাব (ইয়াহূদী) ইবরানী ভাষায় তাওরাত পাঠ করে মুসলিমদের কাছে তা আরবী ভাষায় ব্যাখ্যা করত। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা আহলে কিতাবকে বিশ্বাসও কর না আর অবিশ্বাসও কর না এবং (আল্লাহর বাণী) ‘‘তোমরা বল, আমরা আল্লাহ্তে ঈমান এনেছি এবং যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে . . . .’’ গ্রন্থ:সহীহ বুখারী (তাওহীদ) / হাদিস নাম্বার: ৪৪৮৫
আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। ইয়াহূদীরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমতে এসে বলল, তাদের একজন পুরুষ ও একজন মহিলা ব্যভিচার করেছে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করা সম্পর্কে তাওরাতে কী বিধান পেয়েছ? তারা বলল, আমরা এদেরকে অপমানিত করব এবং তাদের বেত্রাঘাত করা হবে। ‘আবদুল্লাহ ইবনু সালাম (রাঃ) বললেন, তোমরা মিথ্যা বলছ। তাওরাতে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যার বিধান রয়েছে। তারা তাওরাত নিয়ে এসে বাহির করল এবং প্রস্তর হত্যা করা সম্পর্কীয় আয়াতের উপর হাত রেখে তার আগের ও পরের আয়াতগুলি পাঠ করল। ‘আবদুল্লাহ ইবনু সালাম (রাঃ) বললেন, তোমার হাত সরাও। সে হাত সরাল। তখন দেখা গেল প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করার আয়াত আছে। তখন ইয়াহূদীরা বলল, হে মুহাম্মাদ! তিনি সত্যই বলছেন। তাওরাতে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যার আয়াতই আছে। গ্রন্থ:সহীহ বুখারী (তাওহীদ) / হাদিস নাম্বার:৩৬৩৫
ইবনু উমার (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত।তিনি বলেন, একদা একদল ইয়াহুদী এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ‘কুফ’ নামক উপত্যকায় ততে আবেদন জানালো। তিনি তাদের এক পাঠাগারে উপস্থিত হলেন। তারা বললো, হে আবুল কাসিম! আমাদের এক ব্যক্তি জনৈকা মহিলার সঙ্গে যেনা করেছে। সুতরাং আপনি এদের সম্পর্কে ফায়সালা দিন। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য একটি বালিশ পেতে দিলো। তিনি তাতে বসে তাদের বললেনঃ তোমরা একখানি তাওরাত নিয়ে এসো। তাওরাত নিয়ে আসা হলে তিনি তাঁর নীচে বিছানো বালিশ টেনে নিয়ে তার উপর তাওরাত রাখলেন এবং বললেনঃ আমি তোমার প্রতি এবং তোমায় যিনি নাযিল করেছেন তার প্রতি ঈমান এনেছি। গ্রন্থ:সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত) / হাদিস নাম্বার : ৪৪৪৯
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ যে সব দিনে সূর্যোদয় হয় তার মধ্যে জুমুআর দিনই উত্তম। ঐ দিনেই আদম (আঃ) সৃষ্টি হয়েছিলেন, …..। কাব (রাঃ) বলেন, এইরূপ দু’আ কবুলের সময় সারা বছরের মধ্যে মাত্র এক দিন। রাবী বলেন, আমি তাঁকে বললাম, বছরের একটি দিন নয়, বরং এটা প্রতি জুমুআর দিনের মধ্যে নিহিত আছে। রাবী বলেন, অতঃপর কাব (রাঃ) তার প্রমানস্বরূপ তাওরাত পাঠ করে বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য বলেছেন।
গ্রন্থ:সূনান আবু দাউদ (ইফাঃ) / হাদিস নাম্বার: ১০৪৬
এগুলি অবিতর্কিত হাদীস যা বাইবেলের প্রতি হযরত মুহাম্মদ(সাঃ)-এর মনোভাবের কথা বর্ণনা করে যেমনটি তfর সময়ে বিদ্যমান ছিল। প্রথম হাদীসটি আমাদের জানায় যে ইনজিলের অস্তিত্ব ছিল এবং যখন তিনি প্রথম আহ্বান পান তথনও এটি সহজলভ্য ছিল। দ্বিতীয় হাদীস আমাদের বলে যে ইহুদিরা ইবরানী ভাষায় তাওরাত প্রথম মুসলিম সমপ্রদায়ের কাছে পাঠ করেছিল। মহানবী(সাঃ) তাদের পাঠ্যাংশ নিয়ে বিতর্ক করেননি, তবে তাদের আরবী ব্যাখ্যার বিষয়ে নির্লিপ্ত ছিলেন(নিশ্চিন্ত বা অস্বীকারও করেননি)। পরবর্তী দুটি হাদীস আমাদের বলে দেয় যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার সময়ে তাওরাতকে সালিসি সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য ব্যবহার করেছিলেন। শেষ হাদীসটি আমাদের দেখায় যে তাওরাত যেমন ঐ সময়ে বিদ্যমান ছিল, হযরত মুহাম্মদ(সাঃ)এর মানব সৃষ্টির দিন সম্পর্কে বিবৃতি যাচাই করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল(এটি একটি জুমাবার ছিল)। এক্ষেত্রে, তাওরাত সয়ং হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) নিজে তার দেওয়া শিক্ষা যাচাই করার জন্য ব্যবহার করতেন, সুতরাং এটি অবশ্যই এ জাতীয় ব্যবহারের জন্য নির্ভরযোগ্য ছিল। এই হাদীসের কোনওটিতেই আমরা এমন কোনও ইঙ্গিত দেখতে পাই না, যেখানে বাইবেলের কালাম বিকৃত বা পরিবর্তিত হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে।
ইঞ্জিলের প্রথম দিকের পান্ডুলিপি
প্রথম দিকের নতুন নিয়ম (ইনজীল) এর নথী সম্বলিত একটি বই আমার রয়েছে। এটি শুরু হয়েছেঃ
“এই বইটি দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে চতুর্থ (১০০-৩০০ এডি) এর শুরু পর্যন্ত নতুন নিয়মের হস্তলিপিগুলির ৬৯ টির অনুলিপি সরবরাহ করে … এতে নতুন নিয়মের প্রায় ২/৩ অংশ রয়েছে”
প্রিফেস পি. ১৭. ২০০১
এটি উল্লেখযোগ্য কারণ এই পান্ডুলিপিগুলি রোমান সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন (সিএ ৩২৫ খ্রিস্টাব্দ) এর আগে আসে, কেউ কেউ মনে করেন যে বাইবেলের পাঠ্যকে পরিবর্তন করেছে। কনস্টান্টাইন যদি এটি বিকৃত করতেন তবে আমরা তার সময়ের পূর্বে (যেহেতু আমাদের সেগুলি রয়েছে) তার পরে আসা পাঠগুলির সাথে তুলনা করে এটি জানতাম। তবে কোনও পার্থক্য নেই।
একইভাবে, এই পান্ডুলিপিগুলো এবং বাইবেল অন্যান্য অনুলিপিগুলো হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনেক আগেই লিখিত হয়েছিল। এগুলি এবং অন্যান্য হাজার হাজার পাণ্ডুলিপিগুলি সারা বিশ্ব থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের আগে থেকেই ছিল। যেহেতু নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ৬০০ খ্রিস্টাব্দে তার সময়ে বাইবেলকে নির্ভরযোগ্য হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন এবং নবী জীবিত থাকার শত শত বছর পূর্ব থেকে অদ্যাবধি বাইবেলর অনেক অনুলিপি রয়েছে – এবং সেগুলি আজকের বাইবেলের মতোই, কাজেই বাইবেল অবশ্যই অপরিবর্তিত।
এমনকি খ্রীস্টানদের দ্বারা এই কালামসমূহর পরিবর্তন করার ধারণাটিও ভিত্তিহীন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষের পক্ষে পরিবর্তনগুলির বিষয়ে একমত হওয়াও সম্ভব হত না। এমকি আরবেও যদি এগুলির পরিবর্তন করা হতো, তাহলে তাদের অনুলিপিগুলো এবং তাদের ভাইদের অনুলিপি সমূহের মধ্যকার পার্থক্য, বলতে পারেন সিরিয়া ও ইউরোপের, আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠত। কিন্তু পান্ডুলিপির অনুলিপিসমূহ সারা বিশ্বব্যাপি ও পিছনের দিনগুলোতে একই রকম রয়েছে। যেহেতু কোর’আন এবং হাদীস উভয়ই বাইবেলের কালামসমূহ স্পষ্টভাবে সমর্থন করে যেমনটি ৬০০ খ্রিস্টাব্দেও করা হতো এবং বাইবেল যেহেতু এই সময়ের অনেক আগে থেকে গ্রন্থিত পাণ্ডুলিপিগুলির উপর নির্ভরশীল, তাই আজকের বাইবেলটি বিকৃত হয়নি। নীচের সময়রেখাটি চিত্রিত করে যে, কিভাবে কালামসমূহ ৬০০ খ্রিস্টাব্দের বাইবেলর প্রারম্ভিক সময়ের ভিত্তিতে প্রদর্শিত হয়।
এমনকি তাওরাত ও জবুরের প্রাচীন পান্ডুলিপিসমূহ আরও প্রাচীনতম সময়ের। গোটনো পান্ডুলিপির সংগ্রহগুলো, মৃত সাগর পান্ডুলিপি নামে পরিচিত, যা ১৯৪৮ খ্রীষ্টাব্দে মৃত সাগরের কাছে পাওয়া যায়। এই পান্ডুলিপিগুলি পুরো তাওরাত এবং জবুরকে পরিপূরণ করে এবং এগুলি খ্রিস্টপূর্ব ২০০-১০০ সময়কার। এর অর্থ হ’ল আমাদের কাছে সেই সময়কার অনুলিপি রয়েছে, যা নবী ঈসা আল-মসিহ (আঃ) এবং নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) উভয়েরই আগে। যেহেতু তারা দু’জনেই প্রকাশ্যে তাওরাত ও জবুরকে ব্যবহার ও অনুমোদন দিয়েছিলেন যা তাদের কাছে ছিল, আমাদের নিশ্চয়তা আছে যে নবীদের এই প্রথম গ্রন্থগুলিও বিকৃত হয়নি। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আল কিতাবের নির্ভরযোগ্যতা (বা অপরিবর্তনযোগ্যতা) সম্পর্কে আমি এখানে আমার নিবন্ধে কি বোঝাতে চাচ্ছি তা বিশ্লেষণ করব।
হাদীসসমূহে হয়রত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাক্ষ্য এবং পাশাপাশি বাইবেলের পান্ডুলিপিসমূহের নেপথ্য জ্ঞান, কোর’আনের সাক্ষ্য অনুসারে একই সিদ্ধান্তের ইঙ্গিত দেয় যে-বাইবেলের লেখা বিকৃত বা পরিবর্তিত হয়নি।
এই সময়কার বাইবেলের (আল কিতাব) পান্ডুলিপি – অতি প্রাচিনকাল থেকে